কবি জহির ইসলামের “জোছনা রাতে ফুলের সাথে” কাব্যের জোছনাফুলের পাপড়ি – নাসের ভুট্টো

কবি জহির ইসলাম দরিয়া পাড়ের শব্দসাম্রাজ্যের ডুবে থাকা এক নিভৃতচারী কবি। তিনি একজন স্পন্দিত ছড়াকার, গীতিকার ও কবি। শব্দের আভরণে- অলংকারে নিজের মতো করে নির্মাণ করে চলেছেন কবিতার উর্বশী শরীর। প্রতিক্ষণে কাব্যঘোরে আচ্ছন্ন এ- কবি সৃষ্টির শৈল্পিক অঙ্গীকারে আবদ্ধ থেকে দর্শন এবং সৌন্দর্যের নান্দনিক সংমিশ্রণে চিন্তার নব নির্মাণে প্রাগ্রসর। তিনি প্রয়োজনে কবিতাকে ভেঙ্গেছেন, গড়েছেন। ভাঙ্গা-গড়ার এই নিরন্তর খেলায় ফুটে উঠেছে অনিন্দ্য সুন্দর। সেই সুন্দর আর সুন্দরের বন্দরে কবি সর্বদাই প্রেমের সওদাগর। ঘাটে ঘাটে তিনি ফেরি করেন প্রেম। নারীপ্রেমে মত্ত কবির চুড়ান্ত শব্দ ভালোবাসা। সেই ভালোবাসায় তিনি কবিতা সৃষ্টি করেন, জীবন বিকাশের মতো ধীরে ধীরে। তার ভাষা ভিন্ন, গভীর অনুভুতির ছোঁয়ায় প্রাণবন্ত ও পংঙিতে পংঙিতে আলোড়িত। সদ্য প্রকাশিত কাব্য গ্রন্হ ” জোছনা রাতে ফুলের সাথে” কবির অপূর্ব সৃষ্টির এক জোছনা উৎসব। ছন্দে- গন্ধে অতুলনীয়। মৃত্তিকা সংলগ্ন বাস্তবতার বিচরণে প্রয়াসী এই কবি। সেই চেতনারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে তার কাব্য গ্রন্হ ” জোছনা রাতে ফুলের সাথে”। এই সময়ের কবি জহির ইসলাম তাই অকপটে ব্যক্ত করেন “ভালোবসি ভালো আছি” কবিতায় হৃদয়ের অপ্রকাশিত পংক্তি-
দখিনের জানালায় এখনো দাঁড়াও,
রাতজাগা পাখি আজ ডেকেছে আবার,
অসময়ে পেঁচা ডাকে দুহাত বাড়াও,
ভালোবাসায় মজেছে, সেও কী তোমার?”
জহির ইসলামের কবিতা একরৈখিক নয়, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প, প্রতীক, সমাসোক্তি প্রভৃতি অলঙ্কার নির্মাণে তিনি সবিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। প্রেমের নানা অনুসঙ্গ, প্রসঙ্গ ও বিস্তার, সংগ্রাম ও ক্লান্তি তার কবিতাকে গভীর প্রেমবোধে আলোড়িত করে। উপলব্ধি ও পর্যবেক্ষণও তিনি বহুমাত্রিক। আবার কখনো সখনো জহিরের কবিতায় খন্ড়িত নিসর্গ নয়, এসেছে পরিপূর্ণ নিসর্গ। স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের মতোই বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো এসেছে নিসর্গ। তার কবিতা মধুর এক নৈ:সঙ্গের যন্ত্রনার সীমা- পরিসীমায় পাঠককুলকে পৌছে দেয়। প্রকৃতি তার কবিতায় স্বয়ম্ভু অস্তিত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে মনোজৈবিক সম্পর্কের সূত্র নির্ণীত হয় তার কবিতায়:
“খোদার আরশ কাঁপে পাপের কারণ
জগতে দাপটে চলে শুনে না বারণ
প্রভুর রহম ছাড়া বাঁচে না মানুষ
গজবে আজাব আনে, বিনাশ ফানুস”
কবির বোধির মধ্যে চমৎকার নাজিল। তেলওয়াতে ঝংকার আছে। গভীরে আরো গভীর। কবি জহির ইসলামের কবিতায় সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিশীলতা সম্পর্কে আত্যন্তিক সচেতনতা প্রকাশিত হয়েছে। আজকের এই বিকাশমান সমাজে প্রতিষ্টার দৌড়ে মানুষ ভুলেছে আবেগ- সংযম ও পরিমিতবোধ। যার ফলে মানুষ ভুলেছে নৈতিকতা। বেড়েছে বিভিন্ন পাপের দাপট। কবিতার শব্দপ্রয়োগ ও প্রকরণগত দিক দিয়ে জহির ইসলাম গোড়া থেকেই স্বাতন্ত্র্যভিলাষী। যদিও অক্ষরবৃত্ত ছন্দ তার ছন্দবিন্যাসের ক্ষেত্রে প্রাধান্য নির্দেশক, তবু মাত্রাবৃত্ত বা স্বরবৃত্ত ছন্দের প্রয়োগে তিনি অসফল নন। বিষয়ের তাৎপর্য ও ব্যঞ্জনাকে নবতর আঙ্গিকে উপস্থাপন করার জন্য, অক্ষরবৃত্ত ছন্দকেও তিনি নিরীক্ষার বিষয় করেছেন বহু কবিতায়- যেমন ” জোছনা রাতে ফুলের সাথে” বা আমার গাঁ। হৃদয়াবেগ অপেক্ষা মনননির্ভরতা তার কবিতার বিশেষত্ব- নির্দেশক প্রান্ত হবার ফলে জীবনের গদ্যময় ভঙ্গুর ও গতিচঞ্চল স্বরূপই তার অন্বিষ্ট। ভাবাবেগ সেখানে পুরোপুরি অন্তর্হিত না হলেও তার কবিতা পাঠকের বুদ্ধিবৃত্তিতে সজাগ। ছন্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে অক্ষরবৃত্ত যদিও কবির প্রধান অবলম্বন, তবু অন্যান্য ছন্দের ব্যবহারে অমনোযোগী নন তিনি। “স্বাধীনতার খাম” কবিতাটির প্রথম স্তবক একবার পড়তে চাই-
“সেদিন দেখি বোনের হাতে
রক্তমাখা খাম
সেটাই বুঝি স্বাধীনতা
বাংলাদেশের নাম”
কবি জহির ইসলাম প্রকৃতপক্ষে উপরের কবিতাটি দিয়েই তার কবিচৈতন্যের নবযাত্রা শুরু হলো। যেখানে স্বাধীনতার আদি উৎস থেকে বর্তমান পর্যন্ত তার মানসলোক জীবনাবেগ। স্বাধীনতার অন্তর্গত অবক্ষয় ও আর্তিকে কখনো গভীরতম ব্যঞ্জনায় তরঙ্গিত করে তুলেছেন কবি, কখনো বা বর্তমানের ঐকান্তিক অনুভবে জীবনজটিলতার গ্রণ্হিসমূহ, আবার কখনো সখনো প্রগতির বিপুলা স্রোতস্বিনীতে জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তি সন্ধানের ঐকান্তিক প্রয়াস। “কবিতাবাসর” কবিতায় তার ঐতিহ্যসন্ধান পরিণামে আত্মানুসন্ধানে পরিণত হয়েছে:
” হাঙ্গরের নাচ দেখো,জোয়ার ভাটায়
নদীতীরে ভেসে উঠে সোনালী শামুক
রূপের নাচনে মন, থাকে না ডাঙায়
তোমার দুচোখ আঁকে পোয়াতি ঝিনুক”
এই ঐতিহ্যসন্ধান গভীরতা এবং ব্যাপ্তি পেয়েছে কবির কবিতায়। ঐতিহ্য, নৃতত্ব এবং জীবনপ্রবাহ পরম্পরায় বিপুল উৎসের অঙ্গীকারে মানবীয় অন্বেষার সমগ্র প্রান্তকে স্পর্শ করে গেছেন কবি। মূলত: তার কবিতা শিল্পের চিরাচরিত খোলস ভাঙ্গার অদম্য স্পৃহা তাকে দান করেছে স্বকীয়তা, এনে দিয়েছে বিশিষ্টতা। তাই তিনি দেশ, দেশের মানুষ ও মাটির গান গেয়েছেন প্রার্থনার ভাষার মতো নীরবে নি:শব্দে। কবি জহির ইসলাম যে মনমাতা শব্দবন্ধে – চৌকশ কাব্যবিভায় আঁকলেন তা এক কথায় অপূর্ব। যেমন-
“বৃষ্টির পানিতে গা- টা ভিজে
কালো চুলে গাঁথে ফুল নিজে
মাঝে মাঝে উঁকি দেয় তারে
ভালোবাসা ভালো লাগে যারে”
কবি জহির ইসলামের “ভালোবাসি বর্ষা” শিরোনামের উপরোল্লিখিত কবিতার কয়েকটি চরণ পড়তে বেশ লাগে। এখানে কবির কাব্যিক ভাবনার গভীরতম অন্তকণার গন্ধভার আলোক ফুল তুলে আনলেন বিস্ময়কর অনুপ চিন্তনে। তাই, অকপটে স্বীকার করতে হয় ভালোবাসাতে বিলীন মনের মানসিক প্রশান্তির রূপ ওঠে এসেছে কবি জহির ইসলামের শব্দের মায়াজালে- যেখানে জীবন, যৌবন ও প্রজন্ম নিয়ে বহমান কবি যাপিত জীবনের প্রতিচ্ছবি সুরছন্দে- শব্দে, ভিন্নতর আবহে তুলে ধরেছেন যে, কবি জহির যেন ‘হ্যামিলেনের বাঁশিবাদক”! ভাব ও শব্দ তরঙ্গের মায়াজালে তিনি বিস্তার ঘটিয়েছেন ভিন্নতর জীবন বোধের। কারন অজস্র ভীড়ের মাঝে তিনিও বাজাতে জানেন অস্তিত্বের নির্মোহ বাঁশি। সমকাল নয় মহাকালই তার অভিযাত্রিক চৌম্বক নিশানা। “জোছনা রাতে ফুলের সাথে” কাব্যটির রেখে যাবে বাংলা সাহিত্যের পথে প্রার্থীত চিহ্ন রেখে যাবে বাংলার উর্বর জমিনে- এমন কাম্য নিশ্চয়ই অন্যায্য নয়।

নাসের ভূট্টো
কবি ও প্রাবন্ধিক,

Spread the love

পাঠক আপনার মতামত দিন