‘ভ্রমণে ভাবনায় সিলেট’ ইতিহাসের কালচেতনায় অভিযাত্রা


সুলতানা দিল আফরোজ পূরাণ- আশ্রিত ও ইতিহাস- ঐতিহ্যমগ্ন ভ্রমণপিপাসুদের একজন। আত্মার বিকাশ ঘটাতে বেশ পটু। স্মৃতিপটে এতকাল জমে থাকা গভীর রেখাপাতের রেশগুলো বহুকাল পর ইতিহাসের কালচেতনার মধ্যে সুলতানার অভিযাত্রা। মৃত্তিকা
সংলগ্ন বাস্তবতার বিচরণে প্রয়াসী। সেই চেতনারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাঁর তৃতীয় গ্রন্হ ‘ভ্রমণে ভাবনায় সিলেট’। লেখকের সাবলীল লেখনীতে উঠে এসেছে সিলেট জনপদের ইতিহাস,ঐতিহ্য আর দর্শনীয় স্থানের প্রাঞ্জল বর্ণনা। পাঠক এই ভ্রমণের বর্ণনায় একাত্ম হয়ে তাঁর মানসপটে প্রত্যক্ষ করতে পারবেন সেই সময়ের সিলেটকে। অনুভব করতে পারবেন প্রকৃতির রূপবৈভব নিঙড়ে নিঙড়ে আস্বাদন ও সৌন্দর্যবন্দনা।
এই সময়ের কথাসাহিত্যিক সুলতানা দিল আফরোজের আত্মস্মৃতিমূলক গ্রন্হ প্রাণে- ঘ্রাণে, বিষয়- আশয়ে বাংলা সাহিত্য এক অভুতপূর্ব ভ্রমণকর্ম এবং আন্দোলিত জীবনের দীঘল ছায়ানামা প্রশান্ত সরোবর। স্মৃতিগুলো উপমায় উৎপ্রেক্ষায়, অনুপম চিত্রকল্পে- বিচুর্ণ রূপকল্পে- অনাস্বাদিত শব্দবন্ধে- অতুল বুননে- প্রেমার্ত চয়নে বিস্ময়করভাবে মনোমুগ্ধকর, চিত্তাকর্ষক, হৃদয়গ্রাহী ও অপূর্ব সৃজন মমতায় সিক্ত- যা এক কথায় অসাধারণ মানদন্ডের প্রতিটা ক্ষেত্রে সমৃদ্ধতায় অনন্য, চেতনার বহুমুখী সড়কে ফুটিয়ে তুলেছেন অতীতের দিনগুলোর জ্বলজ্বল করা স্মৃতির অম্লান রাজত্ব। ঐতিহ্যস্নাত জনপদের সাতকরা ও প্রাণের সিলেট এর নাড়ীর বাঁধন ফুটে ওঠেছে তাঁর দীর্ঘ বুননে কুশলী অন্তর্বয়নে। যার অভিজ্ঞতার আপাতবাস্তব সত্যের সমীকরণে তৈরী করেছেন সহজাত সন্মোহন- যা স্মৃতির পৃষ্ঠা উল্টিয়ে ধ্বনিময় ব্যঞ্জনার প্রাচুর্যকে প্রাণবন্ত করে তুলে পাঠকের শ্রুতিসত্তায়। যেখানে শব্দপ্রবাহ সুরমা নদীর মতো মুখর ও বহুমাত্রিক ভাবে- চিত্রে পরিপূর্ণ, যেন উপচে পড়া ও চমকপ্রদ সুরমা নদীর তীর, যার পাশে শাহজালালের পবিত্র মাজার।
ইত্যাকার নানান অনুভব ও অভিজ্ঞতার বহুবর্ণিল আলোছায়ায় বেড়ে ওঠে কথাসাহিত্যিক সুলতানা দিল আফরোজের ‘ভ্রমণে ভাবনায় সিলেট’ গ্রন্হে। তিনি সিলেটের প্রাচীন শেকড় সন্ধান করেছেন অহর্নিশ আর সিলেট জনপদের ধামাইল গানগুলোও কেবলই শেকড়ের দিকে অভিযাত্রা, কখনো সখনো শোভাযাত্রা সঙ্গীত প্রেমীদের প্রতি। লেখিকা প্রকৃতির মোহময় রূপ সার্থকভাবে তাঁর গ্রন্হে ছাড়িয়ে দিয়েছেন দেশ কালের চৌকাঠে। অতিক্রম করেছেন সীমাকে। দেখেছেন নিসর্গ কিভাবে মুদ্রিত হয় হৃদয়ের অদৃশ্য ভ্রূণে।
কথাসাহিত্যিক সুলতানা দিল আফরোজ শব্দচয়ন ও ঐতিহ্যের দিকে যথেষ্ট সচেতন। বুননের মাধ্যমে তুলে এনেছেন সিলেট অঞ্চলের আদিবাসীদের কঠিন জীবন-যাপন, সাংস্কৃতিক জীবনধারা পাশাপাশি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সিলেট ভ্রমণের বিষয়ও বাদ দেন নি। বাঙালির রসনা বিলাস বিশ্ব পরিচিত তাই মাছ এবং মাংস রান্নায় সাতকরা ব্যবহার ও বিবিধ ঐতিহ্যবাহী খাবারের বিভিন্ন স্বাদও পাঠে অনুভব করা যায়। ইতিহাস- ঐতিহ্য,ধর্মীয় বৈচিত্র্য আর পর্যটনে অনন্য সিলেট অঞ্চল কে লেখিকা তাঁর সমস্ত লেখকসত্বা দিয়ে এমন ভাবে ফুটে তুলেছেন যে কোন পাঠক হারিয়ে যাবে সিলেটের পাহাড়, টিলা ও সমভূমিতে। যেখানে এক সময় হারিয়ে গিয়েছিলেন রবার্ট লিন্ডস।
এইখানে লেখক দৃষ্টিপাত জীবনমূখী দর্শনের আশ্রয়ে নিবিষ্ট হয়েছে। জীবন মৃত্যুর চরম সত্যকে সামনে রেখে সৃষ্টির সৌন্দর্যকে দেখালেন। মাইলের পর মাইল সবুজ চা বাগান, হাওরবাসীর জীবনে অর্থনৈতিক থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডও নিপুণ ভাবে তুলে ধরেছেন কথাসাহিত্যিক সুলতানা দিল আফরোজ।
সুলতানা দিল আফরোজ শব্দচয়নের দিকে যথেষ্ট সচেতন। ভ্রমণকে লাবণ্যময় করে তুলতে তিনি শব্দ, উপমা, রূপের ব্যবহারে সার্থক এবং সফল এ ক্ষেত্রে। মানবিক পরিত্রানের পথ অনুসন্ধানে তিনি হয়েছেন ত্রিশঙ্কু। সিলেটের অতীত যেমন ইতিহাস বিজড়িত! তেমনি সিলেটের নামকরণেও আছে ধর্মীয় ইতিহাস সমৃদ্ধ। সিলেট ভ্রমণে গিয়ে লেখক উপলদ্ধি করেছেন, সমুদ্রের জোয়ারভাটা আর নোনা জলের উপর বেঁচে আছে অজস্র প্রাণ । তাই ‘ভ্রমণে ভাবনায় সিলেট’ চিত্রকল্প যেমন ভিন্ন মাত্রায় এসে হাজির হয় তেমনি স্মৃতির শব্দ ও পদের ব্যবহারও ভিন্ন আমেজ সৃষ্টি করে। তিঁনি বিশেষ্য, বিশেষণ, সর্বনাম, ও অব্যয় পদকে নতুন নতুন রূপ দিয়েছেন যা ফুটে ওঠে শতবর্ষে। ফলে তাঁর গ্রন্হখানি পলকেই হয়ে ওঠে স্হানিক থেকে বৈশ্বিক।
সমকাল নয়, মহাকালই তার চৌম্বক নিশানা। এমনিতেই গ্রন্হের ভাবনাগুচ্ছের বহুরৈখিক ওমে ডানা মেললো এই লেখকের সফল ভ্রমণচাষ ‘ভ্রমণে ভাবনায় সিলেট’। ধ্রুপদী এই গ্রন্হের প্রতিটি স্মৃতির গতিমান পদক্ষেপ অপূর্ব ঘ্রাণ হয়ে প্রত্যাশিত পথের চিহৃ রেখে যাবেন নিশ্চয় বাংলার সাহিত্যে। লেখকের প্রজ্ঞা আর জীবনবোধ এই বইটিকে করে তুলেছে অনন্য। আশা করছি বইটি পাঠকমহলে সমাদৃত হবে।

লেখক


কবি ও প্রাবন্ধিক নাসের ভুট্টো

Spread the love

পাঠক আপনার মতামত দিন