সুলতানা দিল আফরোজ এর “স্মৃতির আঙিনায়” ‘সামাজিক মানুষের বাস্তব প্রতিচ্ছবি’ – সাবেক যুগ্মসচিব।

জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের বধু হিসাবে তৎকালীন যশোর থেকে দূরবর্তী একটি পাড়াগাঁয়ের মেয়ে জ্ঞানদানন্দিনী দেবী মাত্র আট বছর বয়সে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বিতীয় অগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহধর্মিনী হিসাবে ঠাকুর বাড়িতে পদার্পণ করেন। তাঁর বয়েস যখন চৌদ্দ ১৮৬৪ সালে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের প্রথম ভারতীয় সদস্য হিসাবে সরকারি চাকুরিতে যোগদান করেন। ঠাকুর বাড়ির বধুরা গৃহবধুই ছিলেন, তাঁদের অন্তঃপুরের বাইরে যাওয়া ছিল বারণ। সেই কঠোর কঠিন নিয়ম ছিঁড়েফুঁড়ে স্বামীর সঙ্গে স্বামীর কর্তব্যস্থল বোম্বাইয়ে যাওয়া ঠাকুর পরিবারের প্রথম গৃহবধু ছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। তিনি স্বামীর সাথে তাঁর আরো কর্মস্থলে – গুজরাট, ‍সিন্ধু, এমনকি ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স – গিয়েছিলেন।

 

অনেকের মনে হতে পারে, শিবের গীত গাইছি, মোটেও তা নয়। বন্ধুবর সৈয়দ আশরাফের ক্ষেত্রেও আমি ঐ ঘটনার প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছি। তিনিও একটি সম্ভ্রান্ত, ধর্মভীরু ও রক্ষণশীল পরিবারের সন্তান হওয়া সত্বেও তাঁর সৃন্দরী গৃহবধু স্ত্রীকে নিয়ে বিভিন্ন কর্মস্থলে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এমনকি তাঁর স্ত্রী তাঁর কর্মস্থলে ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা ছাপার অক্ষরে লিখেছেন “স্মৃতির আঙিনায়” নামের বইয়ে। ঠিক যেমনটি জ্ঞানদানন্দিনী দেবী লিখেছিলেন “স্মৃতিকথা” নাম দিয়ে। ১৯৪১ সালে ৯১ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৫৬ সালে ৪৪ পৃষ্ঠার এ বইটি কলিকাতার রূপা এন্ড কোম্পানী প্রকাশ করেছিল। আর “স্মৃতির আঙিনায়” প্রকাশ করেছে ঢাকার প্র প্রকাশনী ২০২১ সালে। স্থান-কাল-পাত্র কিংবা পরিবেশ-পরিস্থিতি ভিন্নতর হলেও দুজনের মনের কথা বলার আকুতি কিন্তু একই।

 

আমাদের প্রিয় মাতৃভুমি বেশ কিছুদিন যাবত প্রাণঘাতী ভাইরাস করোনায় বিপর্যস্ত। লকডাউন, সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং, স্যানিটাইজিং, ইত্যাদি কতিপয় নতুন নতুন ইংরেজী শব্দবন্ধ এখন অক্ষর-নিরক্ষর নির্বিশেষে সবার মুখে মুখে। এমনকি বাঙ্গালির তেরো পার্বণেও আমরা ঘরে বন্দী। এর মধ্যে সময় কাটানোর অবলম্বন যথেষ্ট সীমিত। অবশ্য বই পড়া তার মধ্যে অন্যতম ও বিশিষ্ট স্থান দখল করে নিয়েছে।

 

এ করোনাক্রান্ত সময়েও আমাদের প্রিয় লেখক সুলতানা দিল আফরোজ অবিরাম লিখে চলেছেন। “স্মৃতির আঙিনায়” তাঁর দ্বিতীয় বই। তাঁরই সৌজন্যে বইটি পেয়েছি আরো আগেই। কিন্তু অন্যবিধ ব্যস্ততা বা কিঞ্চিৎ অলসতার কারণে পড়ার সময় করে উঠতে পারিনি। কিন্তু যখন শুরু করেছি, পুরোটা শেষ না করা পর্যন্ত স্বস্তি পাইনি। দারুণ পছন্দ করেছি।

 

আমাদের মধ্যে ক’জনাই বা জীবন পথের শেষ লগ্নে এসে খানিকটা ফিরে দেখতে চায়, যাপিত জীবনের চর্বিত চর্বণ। কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায়, “কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!” লেখক সে কাজটাই করতে চেয়েছেন অত্যন্ত নিপুণতা ও বিচক্ষণতার সাথে। আমি মনে করি, তিনি তাতে পুরোপুরি সফল হয়েছেন।

 

বইটির বিষয়বস্তু চমৎকার। লেখক অস্বাভাবিক স্বাভাবিকতায় যান্ত্রিক কার্যকারণ সম্পর্কের নিয়মবদ্ধতার নিয়ন্ত্রণে শৃঙ্খলিত জীবনের সহজ বর্ণনা দিয়েছেন। কোন ধরণের বাগাড়ম্বরপূর্ণ বুলি সর্বস্বতায় যাননি। বইটি সুলিখিত ও সুখপাঠ্য। বইটার পঠন শুরু থেকেই উপভোগ করেছি। বইটির পঠনযোগ্যতা এক কথায় অসাধারণ এবং এটি আমাকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক অদৃশ্য মায়াজালে জড়িয়ে রেখেছে। এখানে ধীরে ধীরে গল্প জমিয়ে তোলার কোন ব্যাপার আমার নজরে আসেনি। এক লাফে আমি আসরের ঠিক মাঝখানে গিয়ে বসে পড়েছি এবং পুরো ব্যাপারটা বুঝে উঠতে উঠতে আমি কাহিনীর শেষপাদে চলে এসেছি। বিশেষভাবে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের জীবনবোধ, সংস্কৃতি এবং সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের বর্ণনা আমি খুবই উপভোগ করেছি।

 

চরিত্র বর্ণনায় লেখক অতি সুক্ষ্ম বৃত্তান্তও বাদ রাখেননি। চরিত্রগুলোর ভাব-ভঙ্গীর উপস্থাপন এতটা নিখুঁত যে, প্রতিটা চরিত্র আমার মনশ্চক্ষে ভেসে উঠেছে। মনে হয়েছে যেন আমি সেই কক্ষে দাঁড়িয়ে আছি। তাঁর শব্দ চয়ন ও বাক্য গঠন একইরূপ চমৎকারিত্বের সাথে সম্পন্ন হয়েছে। আমি প্রতিটি দৃশ্যের খুঁটিনাটি দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পেয়েছি। এখানেই লেখক হিসাবে সুলতানা দিল আফরোজ এর কৃতিত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

 

১৯৮৮ সাল। তাঁর জীবনের একটি মাইলফলক। তিনি সৈয়দ আশরাফ নামের একজন নিরীহ  ভদ্র সরকারি কর্মচারির জীবন সঙ্গী হিসেবে পথচলা শুরু করেন। অবশ্য তাঁর ভাষায় তিনি একজন “চতুর আমলা”, যিনি কিছু সময়ের মধ্যেই তাঁর সাথে ভাব জমিয়ে ফেলেছিলেন। যাহোক, ইতিমধ্যে কর্ণফুলী, মাতামূহুরী, সাঙ্গু, চেঙ্গী, বুড়িগঙ্গা, গড়াই, কালিগঙ্গা. পদ্মার স্রোতধারায় বিস্তর পানি বয়ে গেছে এবং তাঁরা উভয়েই পরিণত বয়সে এসে পৌঁছেছেন। দীর্ঘ তিরিশ বছরের অধিক সময়ের যুগলবন্দী অতিক্রম করে এসে যে আত্মতৃপ্তি তাঁর লেখায় ফুটে উঠেছে, তা’ নিঃসংশয়ে একটি সফল, ফলপ্রসূ ও আনন্দদায়ক জীবনের প্রতিচ্ছবি।

 

বইটিতে লেখকের সরল সত্য ভাষণে দুটো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ হয়ে পড়েছে। প্রথমতঃ তাঁর কমবয়সে বিবাহ সংঘটিত হয়েছিল। তাঁর যখন বিয়ে হয়, তিনি তখন আর দশটা বাঙ্গালি মেয়ের মতো গৃহকর্মে নিপুণা ছিলেন না। এমনকি এক কাপ চা কিভাবে বানাতে হয়, তা’ও জানতেন না। দ্বিতীয়তঃ অভিভাবকদের সিদ্ধান্তে আয়োজিত বিবাহ হলেও তিনি তাঁর স্বামীকে ও তাঁর পরিবারকে প্রথম দর্শনেই ভালবেসে ফেলেছিলেন। এ গুণ একাল সেকাল মিলিয়ে অধিকাংশ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের মাঝে বিরল বৈকি।

 

অপরদিকে দুটো গুরুত্ববহ ঘটনা তাঁর জীবন পথের বাঁকে স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে। প্রথমতঃ তাঁর বড় মেয়ের জীবনাবসান। মেয়েটি পড়ালেখায় তো ভাল ছিলই, আচার-ব্যবহারেও খুব অল্প সময়েই সবার মন জয় করে নেয়ার অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ছিল। চেহারা যেমন মায়াবী, কথাবার্তাও তেমনি হৃদয়-ভুলানো। মা-বাবা তো বটেই আমরা তার প্রচন্ড গুণমুগ্ধ হয়ে উঠেছিলাম। কে জানতো সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা। নিঃসন্দেহে তার বাবা-মা মনে কষ্ট নিয়ে দিনাতিপাত করছেন। মহান সৃষ্টিকর্তা হয়তোবা তাড়াতাড়ি ওকে নিজের কাছে নিয়ে যাবেন বলেই এত গুণের সমাহার ঘটিয়েছিলেন।তিনি পরম দয়ালু ও দাতা। তিনি সবাইকে ভালো রাখুন।

 

দ্বিতীয়তঃ তাঁর ছেলের জন্মলাভ। তিনি লিখেছেন, “আমাদের সকলের মুখে হাসি ফোটাতেই এসেছে”। আবার লিখেছেন, “আমি যেন পেলাম, তাকেই পেলাম”। খুবই আবেগপ্রসূত কিন্তু জীবনের বাস্তবতা। তাঁর ছোট মেয়েটা আইসক্রিম খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল। এখন তাঁরা সকলেই ক্রমশঃ স্বাভাবিক হয়ে আসতে শুরু করলেন। সেই ছেলেটি এখন আমাদের সকলের নয়নমণি।

 

যদিও প্রেক্ষাপট ভিন্ন, তবুও আরেকটা বইয়ের প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে চাই। তা’ হলো সুনন্দা শিকদারের “দয়াময়ীর কথা”। ময়মনসিংহের প্রান্তিক গ্রাম এলাকার মেয়ে সুনন্দা বইটিতে তাঁর শৈশবকালে দেশভাগ ও দেশভাগ-উত্তর সময়কালের স্মৃতি বয়ান করেছেন। অসম্ভব সুন্দর, সম্পূর্ণ ব্যাকরণসম্মত একটি স্মৃতিকথা। ব্যাকরণসম্মত এই অর্থে যে, লেখিকা এখানে শুধু আদ্যোপান্ত স্মৃতিচারণই করেছেন – জিন্নাহ, নেহরু, কংগ্রেস বা মুসলিম লীগ প্রসঙ্গ তাঁর রচনায় একবারও আসেনি। পরিণত বয়সে তিনি তাঁর বোধবুদ্ধি ও সারল্য দিয়ে পঞ্চাশের দশকটিকে বিচার করেছেন এবং নিজের আত্মকথা লিখেছেন। নিঃসন্দেহে “দয়াময়ীর কথা” ঐ দশকের পূর্ববাংলার একটি ঐতিহাসিক দলিল হয়ে আছে। একইভাবে লেখিকা তাঁর “স্মৃতির আঙিনায়” গ্রন্থে আশি ও নবব্বইয়ৈর দশকের বাংলাদেশী সমাজের ছাপচিত্র তৈরি করেছেন, যা সম্পূর্ণ আবেগ কিংবা পক্ষপাত বর্জিত। বিশেষতঃ যে কালে আমলারা এবং তদীয় স্ত্রীগণ বিশেষ কোন মহলের গুণকীর্তন করতে গিয়ে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন। আমার ধারণা, সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বইটি কালের সাক্ষী হিসাবে একদিন ইতিহাসের উপাদান হবে।

 

লেখকের জন্ম একটি আধুনিকমনস্ক গেরস্থ পরিবারে। সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে থাকা, একসাথে ডালভাত খেয়ে বিরিয়ানীর ঢেকুর তোলা, একে অন্যের সুখে সুখী ও দুঃখে দুঃখী হওয়া, কারো বিপদে-আপদে সবাই একজোটে ঝাঁপিয়ে পড়া, ইত্যাদি এ জাতীয় পরিবারের বৈশিষ্ট্য। তাই পরিণত বয়সেও তিনি তাঁর ভাই-বোন, চাচা-ফুফু, মামা-খালা, ইত্যাদির দিক থেকে দুর সম্পর্কের কোন তস্য আত্মীয়ের খোঁজ রাখাও দায়িত্ব মনে করেন। বইটিতে তিনি হয়তোবা নিজের অজান্তেই মানুষ হিসাবে তাঁর এ বিরল গুণের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।

 

সুধী পাঠক মাত্রেই বইটি পছন্দ করবেন বলে আমি বিশ্বাস করি। মূখ্যতঃ একজন সরকারি কর্মকর্তার ছায়াসঙ্গী হিসাবে স্মৃতিকথার ঢংয়ে বইটি লেখা হলেও সকল শ্রেণীর সামাজিক মানুষেরা এতে তাঁদের জীবন গল্পের বাস্তব প্রতিচ্ছবি দেখতে পাবেন। বইটি আপনার সময়ের সদ্ব্যবহার নিশ্চিৎ করবে এবং আপনার জন্য উপভোগ্য হবে বলে মনে করি।

 

স্মৃতির আঙিনায় বইটির পর্যালোচনাটি লিখেছেন

এস এম মেসবাউল ইসলাম

সাবেক  যুগ্মসচিব

প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রনালয়।

Spread the love

পাঠক আপনার মতামত দিন