আমি” এস এম আবুল কালাম আজাদ,”
নিউজ ২৪লাইনঃ
বিত্তশালী পিতার সাহায্য ছাড়াই কঠোর পরিশ্রমে এক প্রজন্মেই সফলতা পেয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নুল হক সিকদার। ধনীর সন্তান হলেও জীবনের প্রয়োজনে পাকিস্তান ইপিআরে চাকরির পাশাপাশি নিজের ট্রাকে ড্রাইভারিও করেছেন। পরিবহন ব্যবসা থেকেই শুরু, যা পরবর্তীকালে ব্যাংক, বীমা, বিদ্যুৎ উৎপাদন, এভিয়েশন, গার্মেন্টসসহ নানা ধরনের ব্যবসায় সফল ছিলেন জয়নুল হক সিকদার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহচর ও দেশ-বিদেশে সফল এই ব্যবসায়ী নারী শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তি শিক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমে অবহেলিত এক জনপদকে আলোকিত করেছেন। আজন্ম কাজপাগল এই মানুষটি ৯০ বছর বয়সেও মাসের ৩০ দিনই অফিস করেছেন। গত ১০ ফেব্রুয়ারি ৯১ বছর বয়সে বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষানুরাগী ও বিশিষ্ট শিল্পপতি জয়নুল হক সিকদার মারা যান।
দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী ও সিকদার গ্রুপের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদারসহ তার চার ভাইয়ের জন্ম আসামে। জয়নুল হকের জন্ম ১২ আগস্ট ১৯৩০ সালে। শৈশবে ভারতের বিভিন্ন স্কুলে পড়াশোনা করলেও বরিশাল থেকে ১৯৪৯ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভেঙে দুটি আলাদা রাষ্ট্র তৈরি হওয়ায় ঢাকায় থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এজন্য জয়নুল হক সিকদার পিতার কাছে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় জমি ক্রয় করে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য ৫০ হাজার টাকা চেয়েছিলেন। তার পিতা এ প্রস্তাবে সম্মত না হওয়ায় তিনি ১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আসামের বাড়ি থেকে পালিয়ে আবারও ঢাকায় চলে আসেন। এরপর থেকেই চলতে থাকে জয়নুল হকের জীবন সংগ্রাম।
আসামের বাড়ি থেকে পালিয়ে ঢাকায় এসে একজন দক্ষ ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে আধাসামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়ে চাকরির পাশাপাশি রাতে নিজে ট্রাকের ড্রাইভারের কাজ করতে দ্বিধা করেননি। শুরুতে ট্রাক ব্যবসায় সমস্যার মুখে পড়লেও পরবর্তীকালে ঠিকঠাক চলতে থাকেন। ভাড়ার চাহিদাও বাড়তে থাকে। মাত্র চার মাসের ব্যবধানে আরও তিনটি ট্রাক ক্রয় করেন তিনি। ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে আইয়ুব খানের জারি করা মার্শাল ল’র আগে প্রভিনশিয়াল ইঞ্জিনিয়ার্স কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে চারটি ট্রাক দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন তিনি। কঠিন অধ্যবসায়, অবিরাম সাধনা, দৃঢ় প্রত্যয় দ্বারা জয়নুল হক সিকদার তার বালক বয়সের চিন্তা ‘আবাসন ব্যবসা’র সফলতা বাস্তবে রূপ দেন। নিজ প্রচেষ্টায় সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি ছিলেন জয়নুল হক সিকদার। আজীবনের যোদ্ধা জয়নুল হক সিকদার প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী, দূরদর্শী, বিচক্ষণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণে ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন একজন মানুষ ছিলেন। দেশের অর্থনীতিতেই তার ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটাননি। বিদেশেও বিনিয়োগ সম্প্রসারিত করেছেন। সফলতা কুড়িয়েছেন।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের পাশাপাশি শিল্পেও সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে গেছেন জয়নুল হক সিকদার। ইপিআরে চাকরিকালীন সময়ে একটি ট্রাক কেনার মাধ্যমে যে ব্যবসার সূত্রপাত সেটিই গত ছয় দশকে রূপান্তরিত হয় একটি বৃহৎ শিল্প গ্রুপে। রাজধানী ঢাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলায় বিনিয়োগ রয়েছে সিকদার গ্রুপের। দেশের গন্ডি পেরিয়ে সিকদার পরিবারের ব্যবসা সম্প্রসারিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের অন্তত এক ডজন দেশে।
চিকিৎসা সেবায় নারীদের এগিয়ে নিতে দেশের প্রথম বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল করেন তিনি। ১৯৯২ সালে জন্ম নেয় জেড এইচ সিকদার মহিলা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। বর্তমানে মোট ১০ লাখ বর্গফুট আয়তনের ভবনের মধ্যে এক লাখ বর্গফুট কলেজের জন্য এবং ৯ লাখ বর্গফুট হাসপাতালের জন্য নির্মিত। ৫০০ শয্যার এই হাসপাতালটিতে গরিব রোগীদের চিকিৎসার জন্য ৫০টি ফ্রি বেড রয়েছে। এই হাসপাতালটির গুলশান শাখা উদ্বোধন হয় ২০০০ সালে, যেখানে ২০০ শয্যা রয়েছে। হৃদরোগের আধুনিক চিকিৎসা তিনিই প্রবর্তন করেছিলেন গুলশান ও রায়েরবাজারের জেড এইচ সিকদার উইমেন্স মেডিকেল কলেজ ও কার্ডিয়াক হাসপাতাল করে। ভারতের প্রখ্যাত হার্টের সার্জন ও নার্স এনে স্বল্পমূল্যে দেশে হৃদরোগের বিশ্বমানের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করেন।
জয়নুল হক সিকদার তার নিজ জেলা শরীয়তপুরে স্কুল-কলেজ, মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতালসহ বিভিন্ন অবকাঠামো গড়ে তুলেছেন। নিজ খরচে পাকা রাস্তাঘাট বানিয়েছেন। প্রান্তিক অঞ্চলে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জের মধুপুরে মনোয়ারা সিকদার মেডিকেল কলেজ গড়ে তুলেছেন তিনি। একই এলাকায় জেড এইচ সিকদার ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি প্রতিষ্ঠা করেছেন। গ্রামের মানুষের আর্থিক সেবা নিশ্চিত করতে শরীয়তপুরে ন্যাশনাল ব্যাংকের ১০টি শাখা স্থাপন করেছেন। এমনকি সেখানে তৈরি হচ্ছে হেলিকপ্টার ট্রেনিং স্কুল ও বিমানবন্দর। এ অঞ্চলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমে অবহেলিত এক জনপদকে আলোকিত করেছেন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বীরের মতো লড়াই করেছেন বঙ্গবন্ধুর সহচর জয়নুল হক সিকদার। প্রায় তিন হাজার মুক্তিযোদ্ধার একটি দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। গড়ে তুলেছিলেন আক্কাস বাহিনী। স্বাধীনতার পর সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সবাই যখন নিশ্চুপ ছিলেন, তখন একমাত্র জয়নুল হক সিকদার ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু পরিবারের কুলখানি করেন।
জয়নুল হক সিকদার সপরিবারে দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে থিতু হয়েছিলেন আশির দশকের শুরুতে। যদিও আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে যাতায়াত ছিল তার। জয়নুল হক সিকদার ও তার স্ত্রী মনোয়ারা সিকদার যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। পাশাপাশি এ দম্পতির আট সন্তানের প্রায় সবার যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব রয়েছে। এ দম্পতির তিন মেয়ে হলেন নাসিম সিকদার, পারভীন হক সিকদার, লিসা ফাতেমা হক সিকদার। এর মধ্যে পারভীন হক সিকদার বাংলাদেশে বসবাস করেন। বাকি দুই কন্যাই স্থায়ীভাবে বসবাস করেন যুক্তরাষ্ট্রে। জয়নুল হক সিকদারের পাঁচ ছেলের মধ্যে সবার বড় হলেন মমতাজুল হক সিকদার। অন্য ছেলেরা হলেন নিক হক সিকদার, দিপু হক সিকদার, রিক হক সিকদার ও রন হক সিকদার। তবে দেশের বাইরে অবস্থান করলেও এ দম্পতির সব সন্তানই সিকদার গ্রুপের পরিচালক। পাশাপাশি জয়নুল হক সিকদারের নাতি-নাতনিদের মধ্যে মনিকা সিকদার, মেন্ডি সিকদার, জেফ্রী সিকদার, জোনাস সিকদার, সিন হক সিকদার, জন হক সিকদারও শিল্প গ্রুপটির পরিচালক হিসেবে রয়েছেন।