কবি নাসের ভূট্টো’র ‘কবিতা সমগ্র’ ও সামগ্রিক চেতনা – আলী প্রয়াস
কবি নাসের ভূট্টো’র কাব্য মানসের বৈশিষ্ট অন্যত্র, সমকালীন কাব্য সতীর্থ থেকে পৃথক। আধুনিক কবির রোমান্টিক গীতি ধর্মিতার চেয়ে মহাকবির ক্লাসিক ধৈর্য্ তাঁর মানস গঠনে বিশিষ্টতা দিয়েছে তাই প্রতিটি গ্রন্হের জন্য একটি পৃথক এবং সামগ্রিক চেতনা ধারনে তিনি তৎপর। একটি কাব্যগ্রন্হের জন্যে সামগ্রিক চেতনা রূপায়ন আধুনিক বাংলা কাব্য পরিত্যাগ করেছিল- কবি নাসের ভূট্টো তা পুনর্বিবেচনা করেছেন। কবি নাসের ভূট্টো’র কবিতার মৌল প্রবণতা তার ইতিহাস চেতনা মহাকালের ইশারা থেকে উৎসারিত যে সমাজ সময়চেতনা – সে সময়ের মধ্যে সংস্হাপিত মানুষের জৈবিক অস্তিত্ব এবং পরিণতি লিপিবদ্ধ করা। কবি নাসের ভূট্টো যে কারনে আলাদা সেটি হল- এ জনপদের ভয়াল শ্বাপদ রূপের পাশাপাশি সম্ভাবনাও তিনি আবিস্কার করেছেন। চিত্রের যেদিকটি আবিস্কার করেছিলেন এস,এম সুলতান- কবি নাসের ভূট্টো তাঁর কবিতায় সেই কাজটি করেছেন। সুলতানের চিত্রকলায় আমরা পাই, কৃষি নির্ভর সমাজের পেশীবহুল মানুষ, সেই সময়ের সংগ্রামশীলতা। কবি নাসের ভূট্টো কবিতা পড়ুয়ার পাঠ-অভিজ্ঞতাকে মাঝে মাঝে অতিক্রম করে যেতে চায়। নাসের ভূট্টো বৈচিত্র পিয়াসীমন, তাঁর একটি গ্রন্হ থেকে আরেকটি গ্রন্হ সৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে আলাদা হয়ে যায়। যদিও পরিণামের একটি লক্ষ্যে তাঁর অভিজ্ঞতা নাসের ভূট্টো’র কাব্যগ্রন্হের নাম বিবেচনায় সে সত্য ধরা পড়েঃ ‘অনিবার্য ধুলো রোজই ওড়ে, দীঘিভরা প্রাচীন মেঘ, অন্তঃস্হ স্মৃতির কোঁচড়, ঈশ্বর এবং অন্ধকার সমুদ্র, বিনয়াবনত, সুন্দরের অনন্ত বৈভব এবং এবারের বইমেলার চুড়ান্ত রূপায়ণের আত্বজ কাব্য বৃক্ষ ‘ কবিতা সমগ্র ‘। গ্রন্হটি তৃতীয় প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত। বইটি উৎসর্গ করেন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় বাংলার নদীমাতৃক মানুষ প্রয়াত কৃষিবিদ জামাল আহমদ কে। নান্দনিক প্রচ্ছদ করেছেন রাশেদ আলম।
প্রথাবিরোধী লেখক নাসের ভূট্টো মূলত কবি ও প্রাবন্ধিক। ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির প্রতি তীব্র আকর্ষন। সাহিত্য- সংস্কৃতি- সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে যুক্ত আছেন বিভিন্ন সংঘঠনের সাথে। নিয়মিত বর্ণচাষ করেন জীবন বিকাশের মতো ধীরে ধীরে। নাসের ভূট্টো মূলত নব্বই দশকের কবি। তিঁনি তার কাব্যসমগ্রে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন- উত্তাপ স্পর্শে ঘুরে যাওয়া গতিপথ, নির্বাসনে অর্জন করা আত্বশুদ্ধি ও মানুষের বিশ্বাসের অন্তঃসারশূন্যতা।
কবির ক্ষেত্রে কোন বিবেচনা চুড়ান্ত নয়। মানব মনের বিচিত্রমুখী চেতনার সবটুকু সে ধারন করতে চায়। একই দর্শনে স্হিতি থাকা কবির ধর্ম নয়।
কবি নাসের ভূট্টো কবিতায় জীবনযাপন লক্ষ্য করা গেলেও তাঁর হাহাকার তাঁর কাছে বর্তমানের মুল্য সর্বাধিক কারন তার মধ্যে রয়েছে ভবিষ্যত নির্মাণের প্রতিশ্রুতি। কবি নাসের ভূট্টো’র কাছে অতীতের যে মুল্য তা ইতিহাসের ধাম্ভিকতার মধ্যে রয়েছে। নাসের ভূট্টো মানুষের ক্রমিক উন্নতির সম্ভাবনার আস্হাশীল। কবিকে হতে হবে বর্তমানের প্রতি দায়িত্ববান এবং ভবিষ্যতের দ্রষ্টা। ষষ্ট পর্বে বিভক্ত ‘কবিতা সমগ্র’ কাব্যগ্রন্হটি। সব মিলিয়ে দুইশত আটাশি টি কবিতার সমাহারে অনন্য মাত্রায় অভিযোজিত হয়েছে। স্বোপার্জিত অভিঞ্জতা, স্বতন্ত্র মনোভঙ্গি কাব্যটিকে নিশ্চয় পাঠকের দরবারে বিশেষ মর্যাদা লাভে অভিষিক্ত করবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
মানুষের জীবনে খন্ড় খন্ড় অভিজ্ঞতার সমাবেশ। সেই সমাবেশে নানা রঙ – আনন্দ, বেদনা, সুখ ও দুঃখের অনির্বচনীয় এক অনুরণন। সময়ের ক্যানভাসে এইসব অনুরণন নানা বর্ণবিভায় উদ্ভাসিত হয়। তেমনি ‘কবিতা সমগ্র’র কাব্যগ্রন্হের ‘ বিরহ সমুদ্র’ কবিতার প্রথম স্তবকটি গভীর আবেগে একবার পড়তে চাই-
‘ যদি কেউ ভুলেও এই নষ্ট চোখে রাখে
আন্দোলিত চোখ
সে আর দেখবেনা পৃথিবীর সবুজ’।
কবি নাসের ভূট্টো’র প্রেম ও বিদ্রোহের মধ্যে কোন বিরোধ নেই, বরং তা একই উৎসের দুই পরিপূরক প্রতিভাস। যে আন্তর – প্রেরণায় তিনি অধরা নারীকে পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন, ব্যর্থতায় হয়ে পড়েন বিষন্ন, সেই একই প্রেরণায় সত্য-সুন্দর-মঙ্গল প্রতিষ্টায়, স্বাধিকারের বাসনায় তিনি উচ্ছারণ করেন প্রেমের অমুল্য বাণী। প্রেমের অঙ্গনে অধরা নারীর জন্য নিরুদ্দেশ যাত্রা শুরু হয়েছে কাব্যচর্চার প্রারম্ভ থেকেই, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যেমন স্পর্শ করতে পারেন না রহস্যময়ী অপরিচিতার শাড়ির আঁচল, তেমনি পারেন না কবি নাসের ভূট্টোও। কিন্তু এতকাল এই ব্যর্থতার জন্য তাঁর তীব্র হাহাকারবোধ নেই বরং অভিঞ্জতালব্দ- দর্শনাশ্রিত হয়ে আবিস্কার করেছে প্রেমের শ্বাশত-সত্য। অপ্রাপ্তির যন্ত্রনার জন্য এখন আর হাহাকার নেই, নেই ব্যাকুলতা কিংবা বেদনার অলজ্জ চিংকার- বরং এখানে পাই তত্বলোকের উত্তীর্ণ হবার প্রশান্ত প্রতীতিঃ
‘আমার ভেতরে বিদ্যমান
এক আশ্চর্য রকমের কবরস্হান’।
মৃত্যুচেতনা রোমান্টিক কবির স্বভাব লক্ষণ। ‘কবিতা সমগ্র’ কাব্যের ‘নেপথ্যে নির্ঘাস’ কবিতায় নাসের ভূট্টোর মৃত্যুভয় ধরা পড়েছে। পাঠকের আনুগত্য ও আকর্ষণ কেবল একজন কবির সৃষ্টিকর্মের মান ও উৎকর্ষের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, বরং তাঁর জীবনাচার ও বিচিত্র বহুমুখী কর্মকান্ড় ও পালন করতে পারে একটা বড় ভুমিকা। কারণ, লেখকসত্বা কেবল লেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, সেটি লেখকের জীবন ও সৃষ্টির ওপর যেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারে, তেমনই পারে পাঠকের অন্তর্গত কৌতুহল ও আকর্ষণকে আনুগত্যের নিগড়ে বাঁধতে। নন্দিত ও নিন্দিত লেখক নাসের ভূট্টো তেমনই একজন, যিনি খুব কাছ থেকে মৃত্যুকে দেখেছেন। জোট শাসনামলে কারাবরন করেন। তারপরও সত্যকে মিথ্যার মোড়কে আবদ্ধ করেন নি। এখানে কবি প্রজ্ঞাশাসিত এবং অভিজ্ঞতালদ্ধ মানসতার স্পর্শে এসে হয়ে উঠেছে সংঘত, সংহত এবং শূন্যতা তথা বেদনার প্রতীকি- ধারক। যেমনঃ
‘ নাগরিক কৌমুদীর পশ্চাতে
আমিও তোমাতে কিছুটা বিলীন’
প্রকৃতির কবিকে প্রতীক রূপে ব্যবহার না করে চিত্তলোকে ঠাই দেওয়া একজন কবির আজন্ম স্বভাব। কবি নাসের ভূট্টো ‘কবিতা সমগ্র’ কাব্যের ‘বিধুবদন’ কবিতায় সমুদ্র যাপণের নষ্টালজিয়ায় সিক্ত হয়েছেন অকাল প্রয়াত প্রেমিকার সাথে। জিকিরে জিকিরে কবির সত্বা প্রকাশ বিশেষ লক্ষনীয়।
কবি নাসের ভূট্টো কবিতা অনেকাংশে সরল, আধুনিক জটিলতা যা এসেছে তা সরলতাকে অবগাহন করতে যেয়ে। তাই জীবনান্দীয় যে নগর জটিলতাঃ ‘কখনো যেন আমাদের মনও নিজের নয়’, কিংবা কবি শামসুর রহমানের মায়ের কাছে অচেনা ভদ্রলোকের যে মানসিক নির্মিত প্রতিকৃতি।
আমাদের সময়ের বহুমাত্রিক আলোকমানুষ কবি নাসের ভূট্টো। এই কবির কাব্যমানসে রয়েছে ব্যক্তিমানুষ, জাতিমানুষ ও বিশ্বমানুষের সমীকৃতি ও প্রতীতি। কবিরূপে বহুল নন্দিত তিনি। এই অসাম্প্রদায়িক কবি সমকালিন জাতীয় পর্যায়েও এক তাৎপর্যপূর্ন কারুকৃৎ। চৈত্রের দুপুরে জলের তৃঞ্চায় কবি কিছু চাননা। হৃদয় যদি স্পর্শ করে হৃদয়, তবে কবি পৃথিবীতে উৎসর্গ করতে পারেন তাঁর ‘কবি বন্ধু’র জন্য। কবি প্রশ্ন করে খুঁজতে থাকেন, ভাত না ভালোবাসা মানুষের মৌলিক সমস্যা? কবি সন্দিহান তিনি কার জগতে বসবাস করেন। তাই তিনি অকপটে বলেন-
‘ঈশ্বর জানে না
তার ব্যাখাও বিস্তৃতি
অথচ মানুষ ঈশ্বর বিশ্বাসী’
কবি ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতে চান সমগ্র ধরায়, কারনঃ তিঁনি ভালোবাসার কাঙ্গাল। ভালোবাসা দিতে গিয়ে বারবার প্রতারিত হয়েছেন ঈশ্বরের কাছে। যখন ব্যর্থতা স্পর্শ করেছেন তখন তিনি বেদনাহত হৃদয়ে উচ্ছারণ করেছেন ‘আমি মানুষ ভালোবাসি’। ‘মানুষ ও ঈশ্বর’ কবিতায় শাশ্বতিক বিরহকে তিনি আবিস্কার করতে পেরেছেন বলেই উপলব্দি করেছেন ‘মানু্ষ মানুষের জন্য’। তাই কবি নাসের ভূট্টো বুঝিয়ে দিয়েছেন প্রেমের জগত প্রাপ্তি নয়, বরং অপ্রাপ্তি- মিলন নয় বরং বিরহই চিরায়ত সত্য,শাশ্বত প্রাপ্তি।
প্রত্যেক মহৎ কবি তাঁর নিজস্ব রাজধানীর সঙ্গে গভীর বিজড়িত থাকেন এবং প্রত্যেক সৃষ্টিকর্মেই তাঁর নিজস্ব নগরের একটা বিশেষ রূপ ধরা পড়ে – যা স্বতন্ত্র্য প্রাতিস্কিতায় অতুলনীয়। প্রত্যেক কবিতারই থাকে একটা নিজস্ব চরিত্র, স্বতন্ত্র্য, জলবায়ু, আলাদা বৈশিষ্ট, চাল-চলন,যানবাহন,খাবার-দাবার, স্বতন্ত্র্য ভুগোলের অবকাঠামোর কবিতার চালচিত্র তাঁর আত্মার এ স্বরূপ আমরা চিত্রিত দেখি- তার প্রকাশিত কাব্য ‘কবিতা সমগ্র’। কবির চুড়ান্ত শব্দ- ভালোবাসা। ভালোবাসার আলো-আঁধারী পথে চলতে গিয়ে কবি নাসেে ভূট্টো নিরন্তর নিজেকে ভাংচুর করে প্রবলভাবে নিজেকে তৈরী করেন। বারবার ভালোবাসার শীৎকারে কাতর হয়ে তেলাওয়াত করেন ইবাদতের স্বাদ মন ও মননে। কবি নাসের ভূট্টোর ‘দাখিলা’ কবিতার শেষ স্তবক একবার তেলাওয়াত করতে চাই পরম পবিত্রতায়।
‘ ডাকঘর ফাঁকা…
কেন কাঁদে নিঃসঙ্গ ভেতরের অন্তরঙ্গ মানুষ’
কবির মানসলোকে তেলাওয়াতের ধরণ ভিন্ন হলেও এ কবিতায় ইবাদতের পরমসত্য অনন্ত-মধুর রূপে গ্রহন করেছেন এবং সমস্ত জাহানের সৌন্দর্যসন্ধানকেই আপন কবিসত্তার মৌল ব্রত। সাহিত্য অঙ্গনে শাশ্বত পরমার্থকে আবিস্কার, নিজস্ব প্রকৃতিবোধ এবং গীতল কাব্যরস সৃজনে কবি নাসের ভূট্টোর ‘কবিতা সমগ্র’ একটি বিশিষ্ট কাব্য। কেবল ভাবগত দিক থেকেই নয়, প্রকরণ- প্রকৌশলের দিক দিয়েও একথা সমান প্রযোজ্য। বিষয়ানুগ ভাষা-ব্যবহার, উপমা- রূপক- উৎপ্রেক্ষা ও সমাসোক্তি অলন্কারের শিল্পিত সৃজন এবং ভাবের অন্তরাশ্রয়ী গীতোময় গতিবেগে ‘কবিতা সমগ্র’ কাব্য নাসের ভূট্টোর- কাব্যধারার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নির্মাণ।
লেখক
আলী প্রয়াস
কবি ও প্রকাশক।