সংগৃহীত একটি গল্পের আদলে পবিত্র রমজানের মাহাত্ম্য তুলে ধরার চেষ্টা করছি,”জাপানিজদের কাছে রোজা একটি বিস্ময়ের নাম। সারাদিন না খেয়ে থাকতে হবে। কিন্তু কেন”? এই না খাওয়া নিয়ে তাদের আরো মজার মজার প্রশ্নও আছে। তারা যেসব প্রশ্নগুলো করে, পানিও খাওয়া যাবে না?সিগারেটও না?লুকিয়ে যদি খাও?যদি শাওয়ারে ঢুকে পানি খাও?রোজাদার বাঙালী অনেক হেসে বলে, লুকিয়ে কেন খাবো?আমিতো ইচ্ছে করলে বিরিয়ানী রেঁধে ঘরে বসেই খেতে পারি। কিন্তু ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা কিছুই খাইনা।এটা মহান আল্লাহতালার নির্দেশ। এতে আমরা অভ্যস্ত।তখন শুরু হয় বিস্ময়ের আরেক ধাপ।আবারও একগাদা প্রশ্ন করে জাপানিজ :”কেন খাও না?অদৃশ্য খোদা বলেছেন বলে?তিনি দেখতে পাবেন বলে?তোমাদের এত সংযম!এতটাই আত্মনিয়ন্ত্রণ!!!এরপর জাপানিজ যে দুটো প্রশ্ন করে তাতে বাক্যহারা হয়ে পড়েন রোজাদার বাঙালী।জাপানিজের প্রশ্ন ছিল, “তবে তো তোমাদের দেশে কেউ মিথ্যা কথা বলে না,ঘুষ খায়না,কেউ পাপ করে না,পুলিশ ও লাগে না”।তখন রোজাদার বাঙালীর মুখ থেকে কোন কথা বের হয় না কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। কারণ আমরা জানি ৯০% মুসলমানের দেশ আমাদের।মুষ্টিমেয় হয়তো কিছু মানুষ ছাড়া সবাই রোজা রাখে।কিন্তু আমরা কি বলতে পারবো,রমজানের মধ্যেও মিথ্যা কথা বলা বন্ধ হয়েছে? প্রতারণা, জোচ্চুরি,মোনাফেকি বন্ধ? রমজানে যে খাদ্য দিয়ে ইফতার হয়,সেহেরি খাওয়া হয় তার মধ্যে ভেজাল মিশানো হচ্ছে কিনা,পণ্য গুদামজাত করে বেশি টাকা মুনাফা করা বন্ধ হচ্ছে কিনা, মানুষের হক মেরে খাওয়া বন্ধ হচ্ছে কিনা।অফিস পাড়ায় ঘুষ লেনাদেনা বন্ধ হয়েছে কিনা।ত্যাগ ও সংযমের শিক্ষা নিয়ে রমজান আমাদের দীক্ষিত করতে আসে প্রতিবছর ঘুরে ঘুরে। এই বছর রমজানের সময়টাতে তাপমাত্রা ৪১ডিগ্রী সেলসিয়াসের ঘরে। সারাবিশ্বের মানুষ হেরে যাচ্ছে তাপমাত্রার কাছে।গরমে পিপাসায় কাতর রোজাদার তবুও রোজা রেখে তাপমাত্রাকে হারিয়ে দিচ্ছে। সারাদিন রোজা, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এবং তারাবির নামাজও আদায় করা হয়।কিন্ত এই কঠিন সাধনার ফলপ্রসূ উপলব্ধি আমাদের কতটা তাড়িত করছে। শিরক, কুফরি, সুদ, ঘুষ, মিথ্যাচার, লোভ, হিংসা অহংকার থেকে কতটা মুক্ত হতে পেরেছে মানুষ।প্রশ্ন থেকে যায় অনেক,অনেক প্রশ্ন।
পবিত্র রোজার মাসে আমাদের সমাজে কিছু কুপ্রথা রমজানের মাহাত্ম্যকে নিন্দিত করতে দেখা যায়। তারমধ্যে একটি হলো মেয়ের শশুর বাড়িতে ইফতারি দেওয়ার প্রথা।দরিদ্র পরিবারের জন্য এই প্রথাটি একপ্রকার অমানবিক এবং জঘন্যতম আর ধনীদের জন্য বিলাসিতা ।এই প্রথার প্রচলন মহামারী আকারে ছড়িয়ে শিকড় গেঁড়ে বসে আছে দেশের সকল জায়গায়। সাধারণত: বাঙালী সমাজে মেয়েদের তার পরিবার সব সময় দেখভাল করে। সুখী দেখতে চায়।তাই বিভিন্ন সময়ে বিশেষ কিছু দিনে মেয়ের জন্য হাদিয়া হিসেবে কিছু খাদ্য কিংবা জিনিস পাঠানো হয়।বাঙালী মুসলমানদের প্রাচীন একটি রীতি হচ্ছে মেয়ের শশুর বাড়িতে ইফতারি পাঠানো ।সামাজিক বন্ধনের এটি ছিল একসময় আনন্দের।বাবার সাধ্যমতে দেওয়া হতো কোন বাধ্যগত ছিল না। এবিষয়ে নবী করিম (সাঃ)বলেছেন, “তোমরা একে ওপরকে হাদিয়া দাও,যেন তোমাদের মাঝে ঋদ্ধতা বৃদ্ধি পায়”।
কিন্তু মেয়ের শশুরবাড়ির লোকজন যখন বাধ্যগত ভাবে তাদের চাহিদা মতো দাবি করে এবং কনের উপর ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করে,মানষিক নিপীড়ন চালান, তখন ইফতারি আর সামাজিক বন্ধনের পর্যায়ে থাকে না,হয়ে যায় সামাজিকতার নামে মেয়ের বাবার উপর অবিচার।যা অহরহ হচ্ছে। কখনো দেখা যায় সন্তোষজনক ইফতার না পাঠানো হলে মেয়ের উপর ঘটে মানষিক ও অমানবিক নির্যাতন।কটুকথা অশ্রাব্য গালাগাল। এমনকি শারীরিক ভাবে ও নির্যাতন করা হয়।আদরের মেয়ের সুখের আশায় অনেক বাবা ঋণ করে,গরু বিক্রি করে মেয়ের শশুর বাড়ির চাহিদা মেটায়, আর রাতে ঋণে জর্জরিত বাবা একেলা বালিশে মাথা রেখে কাঁদে।নবী করিম (সাঃ) বলেছেন, “কেউ যদি কাউকে একটি খেজুর দিয়ে ইফতার করায় তাহলে সে রোজাদারের সওয়াব পাবে”। আর বর্তমান সময়ে জোর করে কনের বাপের বাড়ি থেকে ইফতার আদায় করায় সওয়াব তো হবেই না বরং গোনাহের কাজ হবে। পবিত্র কোরানের সুরা বাকারা (১৮৩) আয়াতে এরশাদ হচ্ছে, “হে ঈমানদারগণ ফরজ করা হয়েছে তোমাদের উপর রোজা যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর। যাতে তোমরা সংযমী হতে পারো।মোত্তাকী ও পরহেজগার হতে পারো”।
সর্বোপরি মানুষের অন্তরে তাক্বওয়া’র গুণ সৃষ্টির লক্ষ্যে রোজাকে অবশ্যই পালনীয় ফরজ করা হয়েছে। তাক্বওয়া অর্থ হলো আল্লাহতালার প্রতি ভালবাসা ও ভয়ের অনুভূতি।এই “ত্বাকওয়া” ই হচ্ছে রোজার আসল কথা।ইসলামীক বিশারদদের মতে, “পৃথিবীতে পাপ-পঙ্কিলতার কাঁটা ছড়ানো রয়েছে, তা থেকে সতর্কভাবে নিজেকে বাঁচিয়ে চলার নাম হলো তাক্বওয়া”।আর এর অভাবের কারণেই রমজান মাসে ইফতারি নিয়ে মেয়ের শশুর বাড়ির অযাচিত চাহিদা, ব্যবসায়ীদের খাদ্যে ভেজাল মিশানো, ঘুষ দূর্নীতি চলছে, যা কাম্য নয়।
যৌতুক প্রথা সমাজের একটি অভিশাপের নাম। মুখে যতই যৌতুক বিরোধী কথা বলা হয় না কেন , মেয়ের শশুর বাড়ির সন্তুষ্টি এবং মেয়ের সুখের জন্য প্রায় বাবা মেয়ের বিয়েতে বিভিন্ন আইটেমের জিনিস দিয়ে থাকে সাধ্যমতে।আজকাল বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের অনেক মেয়ে বিয়ে হচ্ছে না যৌতুকের টাকার জন্য। রাস্তা-ঘাটে খেয়াল করলে দেখা যায় যে, অনেক গরীব মা-বাবা মেয়ের বিয়ের জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে হাত পাতে,ভিক্ষা করে।যৌতুক প্রথার কারণে বিবাহ উপযুক্ত বহু মেয়ে পরিবারের বুঝা হয়ে আছে অনেকের । কিন্তু ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ইসলামই নারীদের সর্বোচ্চ সন্মান দিয়েছে। নিরাপত্তা দিয়ে হেফাজত করেছে। কিন্তু আজকাল সমাজে চলমান কিছু বিষয় ইসলামের মুল রীতিনীতির বিপরীত। সভ্যতার নামে অসভ্যতা।বিভিন্ন আইটেমের ইফতার সহ ঈদে মেয়ের শশুর বাড়িতে সবাইকে কাপড়,কোরবানের গরু কিংবা ছাগল সহ বিভিন্ন সময়ে পাঠানো জিনিস যৌতুকেরই শামিল। খবরের কাগজ খুললেই দেখা যায় যৌতুক দিতে অপারগতায় শশুর বাড়ির নির্যাতনে অনেক মেয়ের মৃত্যু এবং বিবাহ ভেঙ্গে যায়। এই কুসংস্কার কত যে ভয়ানক তা একমাত্র ভুক্তভোগী পরিবারই জানতে পারে। তাই এসব কুপ্রথা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে ভবিষ্যতে আরো কত মেয়ে তার শশুর বাড়িতে অত্যাচারিত হতে পারে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ইফতার সুন্নত। কাউকে ইফতার করানো নিঃসন্দেহে সওয়াবের কাজ। কিন্তু ইফতারি কুপ্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর তাগিদ দিচ্ছেন সমাজ নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞ মহল।আলেম সমাজ বিষয়টি নিয়ে মাহফিলে বয়ান করতে থাকলে, সাধারণ মানুষ বেশী করে মেনে চলবে, আশাবাদী সাধারণ মানুষের।
রোজার দিনে এক মা তাঁর সন্তানকে নিয়ে রিক্সায় বাড়ি ফিরছিলেন। প্রতিজন মা’রই তার সন্তানের প্রতি গভীর ভালবাসা থাকে। সন্তানের চেহারা দেখে বলতে পারে সুখ, দুঃখ, ক্ষুধা, তৃষ্ণা এবং সুশিক্ষা নিশ্চিত করার দিকেও তার গভীর মনোযোগ থাকে। চলার পথে ছোট সন্তানটি যখন মার কাছে জানতে চায়, “আচ্ছা মা না খেয়ে থাকলেই কি রোজা হয়?”মা তখন যথার্থ বলেছেন, “না বাবা রোজার সময় সংযম করতে হয়।অন্যের কষ্ট বুঝতে হয় আর মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হয়”। কিন্তু শেষ কথাটি তিনি মনে রাখতে পারে না।তাই একটু পরেই প্রবীণ রিক্সাচালককে বেশ কর্কশ কন্ঠে তিনি বলে উঠেন,”আরে এত আস্তে রিক্সা চালালে তো ইফতার রাস্তায় করতে হবে। জোরে চালান”।রিক্সা চালক তখন অসহায় ভাবে জানান,”সারাদিন রোজা রেখে আর জোরে রিক্সা চালানোর মত শক্তি নেই তার।কথা শুনে থ’হয়ে যান ঐ মা।রিক্সাওয়ালার প্রতি সন্তানের সামনে তার খারাপ ব্যবহার এবং তার প্রভাব তার সন্তানের উপর পড়বে বুঝতে পারে মা।তখনই প্রবীণ রিক্সচালকের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন। তিনি পরিবারের জন্য আনা সমস্ত ইফতারের খাবার মুরুব্বি রিক্সাওয়ালাকে দিয়ে দেন।রোজার মাসের সংযমের শিক্ষা সবার মাঝে ঋদ্ধতা নিয়ে আসুক।মাহাত্ম্য এখানেই।
সবধরনের খারাপ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রেখে, শুদ্ধ হওয়ার পথে অগ্রসর হওয়াই রমজানের শিক্ষা ।ব্যবসার নামে যদি অনৈতিকতা এবং কুপ্রথায় অমানবিকতা প্রদর্শন করা হয় তাহলে,যে রমজান উচ্চ নৈতিক চরিত্র, উন্নত মানবতাবোধ,ত্যাগ,শিক্ষা দেয়,এই পবিত্র মাসের আমল-ইবাদতের সঙ্গে চরম অবমাননাই করা হয়।
————–

লেখক-বদরুল ইসলাম বাদল
সদস্য, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন কেন্দ্রীয় কমিটি.